আলা ইন্না আউলীয়া আল্লাহ্ লা খাওফুন আলায়হিম ওয়ালাহুম ইয়াহ্ জানুন – সূরা ইউনুস , ৬২ আয়াত

র্অথ – নিশ্চয়ই আল্লাহর অলীগণের উভয় জগতে না আছে কােন ভয় আর না আছে কোন বিষন্ন হবার কারন।

     আস্‌সালাতু ওয়াস্‌সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌ ওয়া আলা আলিকা

ওয়া আস্‌হাবিকা ওয়া আউলিয়ায়ি উম্মাতিকা ওয়া সাল্লিম

  সালামুন আলাইকুম ইয়া আরেফে বুয়দ, সুলতানুল সিপাহ্ সালারে গাউসূল আজম,

সাহেবে সিররুল হাকিকত,সাইয়্যেদুল ওলীয়ে মোকাম্মেলে বাংলাদেশ,হযরত শায়খ

  সাইয়্যেদ জালালুদ্দীন মুজাররদ ইয়েমেনী (রাঃ) শায়খুল মাশায়েখ আসসালাম ।

হযরত শাহ্‌ জালাল ইয়েমেনী (রাঃ)-এঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী

মোহাম্মদ রুহুল আমিন সাবের সোবহানী আল-ক্বাদেরী

 

                                                                                              dainikcumilla.com

বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এ দেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় তিনি সুলতানুল বাংলা, হযরত মাওলানা শাহ্জালাল মুর্জারদ ইয়েমেনী (রাঃ)। এতদঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জন সাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম ব্যাপক ও অতুলনীয়।

নাম –  হযরত শাহ্‌জালাল মুজার্‌রদ ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর পূর্ণ নাম জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্‌ । আপামর জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত নাম হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ)

লকব / উপাধিঃ সংক্ষেপে আমরা বলতে চাই  যে  –

ক) একজন ব্যক্তি অনেক সময় সমাজে তার জন্ম স্থানের নামে পরিচিত হন। যা তাঁর মুল নামের শেষে সংযুক্ত থাকে । যেমন- হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রাঃ)।

(খ)  একজন ব্যক্তি তার জন্ম স্থানের নামে পরিচিত না হয়ে বরং জীবনের দীর্ঘ সময় কিংবা মৃত্যুকাল পর্যন্ত যে স্থানে বাস করেছেন সে স্থানের নামেও পরিচিত হন। যেমন- হাজী এমদাদুল্লা মুহাজিরে মক্কি (রাঃ)।

(গ) অনেক  সময় একজন ব্যক্তি তার অর্জিত বিশেষ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, গুন বা দক্ষতার কারনে ও সমাজে পরিচিতি লাভ করেন । যেমন- হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবি(রাঃ)।

(ঘ)  আবার কখনো কখনো ব্যক্তি কোন মহান বুজুর্গের সান্নিধ্য কিংবা পীর-মুর্শিদের সিলসিলার পরিচিতিতে পরিচিত হন । যেমন- হযরত আবদুল করিম হাম্বলী।

ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণের তথ্যগত বিচ্যুতি ও মতভেদের কারনে হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) ও শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী (রাঃ) এর জীবনেতিহাস নিয়ে দ্বন্ধ সৃষ্টি হলেও উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি যে হযরত শাহ্‌ জালাল (রাঃ)ই ইবনে বতুতা বর্ণিত জালালুদ্দীন তাবরিজী (রাঃ) যা সমসাময়িক এবং পরবর্তি নির্ভর যোগ্য ঐতিহাসিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত । হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) তাঁর বহুমুখি গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারনে বাংলার মুসলিম সমাজে বহু লকব বা গুণবাচক উপাধি দ্বারা বিভূষিত। বিভিন্ন শিলালিপি, ঐতিহাসিক ও মনীষীগণের বর্ণনা ও গবেষকগণের রচনাবলীতে সাধারণত নিম্নলিখিত লকবগুলি পাওয়া যায়ঃ শেখ,শায়খুল মাশায়েখ, কুতুব, মুজার্‌রদ,মখদুম, সুলতানুল বাংলা,রিফান বুয়দ, কুতুব বুয়দ, মাওলানা, জালালুদ্দীন, তাবরিজী, ইয়েমেনী, কুন্যাভী,তাইজী, সিরাজী, প্রাচ্য-সূর্য, ইত্যাদি।তাঁর কুনিয়াত হল কোরাইশী।

পিতার নামঃ   হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমনী (রাঃ) এঁর পিতার নাম হযরত শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী (রাঃ)। তিনি একজন কোরাইশ বংশীয় স্বনামধন্য খ্যাতিমান দরবেশ ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত দরবেশ হযরত আবু সাঈদ তাবরিজীর মুরীদ ও খলিফা ছিলেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাঃ) এঁর মত বুজুর্গ ব্যক্তি হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী (রাঃ) এঁর ফয়েজ হাসিল করেন। সুতরাং হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী (রাঃ) এঁর খিলাফত পাওয়া যে কোন লোকের জন্য সহজ বিষয় ছিল না। সম্ভবত এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী (রাঃ) জন্মগতভাবে ইয়েমেনী হলেও সূফী ধারা মোতাবেক নামের শেষে পীরের তাবরিজী উপাধি ধারণ করায় নাম হয়েছে শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী (রাঃ) যা বিভিন্ন শিলালিপি ও ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। শায়খ শাহ্‌জালাল (রাঃ) এঁর বিদুষী মাতা ছিলেন সাইয়্যেদ বংশীয় । হযরত শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী (রাঃ) এঁর পিতার নাম ছিল হযরত শেখ ইব্রাহিম কোরাইশী (রাঃ)।

জন্ম তারিখ ও স্থানঃ   ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে গবেষকগণের মতে হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ)৭৪৬ হিজরী সনে ১৯শে জিলক্বদ ইন্তেকাল করেন। সে মতে তাঁর ১৫০ বছর জীবনকাল ধরে জন্ম সাল হয় (৭৪৬-১৫০)= ৫৯৬ হিজরী । তাঁর জন্মস্থান হল ইয়েমেনের তাইজ নগরীর কুন্যা নামক স্থানে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কোন কোন লেখক হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এবং শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী (রাঃ) কে আলাদা দু জন দরবেশ বর্ণনা করে জালালুদ্দীন তাবরিজীর জন্ম ও ইন্তেকালের তারিখ এবং পান্ডুয়াতে তার মাজার বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু যে সমস্ত গ্রন্থের সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে মূল গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়নি। সে গুলো পরবর্তিতে অপ্রমাণিত হয়েছে এবং পান্ডুয়াতে তার মাযার নেই বলে সেখানকার খাদেমগণই বর্ণনা করেন। সেখানে তার জওয়াব সমাধি বা স্মৃতি সৌধ বিদ্যমান।

শিক্ষাঃ   হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর পিতা-মাতা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন তাঁর বুযুর্গ মামা সৈয়দ আহ্‌মদ কবির সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ)। তিনি সোহ্‌রাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ এবং মক্কার বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) এঁর শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) কে তাঁর মুরীদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আলেম ছিলেন। এছাড়াও হযরত শায়খ্‌ আবু সাঈদ তাবরিজী (রাঃ), হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ) ও হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্‌তী (রাঃ) এঁর মত জগত খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুযুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্যওহযরত কুতুব উদ্দীন বখ্‌তিয়ার কাকী(রাঃ), হযরত ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ (রাঃ),হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া(রাঃ), হাদীস বিশারদ হযরত বাহাউদ্দীন যাকরিয়া মুলতানী (রাঃ), হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রাঃ), হযরত বোরহানুদ্দীন সাগরজী (রাঃ) এঁর মত যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সাথে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) আধ্যাত্মি অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞান রাজ্যের বিভিন্ন শাখায় ও বুতপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন

হযরতের পীরগনঃ    হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) শৈশব থেকে প্রায় ২২/২৩/৩০ বছর পর্যন্ত মামা হযরত সৈয়দ আহ্‌মদ কবির সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ)এঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে শরীয়ত ও মারফতের দীক্ষা গ্রহন ও আধ্যাত্নিক সাধনা করেন। এরপরতিনি আবু সাঈদ তাবরিজী (রাঃ) এঁর নিকট মুরীদ হন এবং তাঁর সোহ্‌বতে প্রায় দুই বছর কাটান। এরপর হযরত শাহ্‌জালাল(রাঃ) সোহ্‌রাওয়ার্দী ত্বরিকার ইমাম হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী(রাঃ) এঁর নিকট মুরীদ হন। এ সূত্রে হযরত শেখ সাদী (রাঃ) হন তাঁর পীর ভাই বাসতীর্থ। শাহ্‌জালাল (রাঃ)প্রায় ৭ বৎসর শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ) এঁর সান্নিধ্যে কাটান। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত শাহ্‌জালাল(রাঃ) হযরত শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রাঃ) এঁর সুযোগ্য পুত্র শায়খ হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ) এঁর নিকট মুরীদ হন এবং দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর তাঁর খেদমতে ছিলেন ।যেহেতু, হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহঃ) হযরত শায়খ জালাল ইয়েমেনী (রহঃ) এঁর পীর ও মুর্শীদ ছিলেন সেহেতু তিনি ধর্মীয় ও আধ্যাত্নিক সম্পর্কের দিক থেকে হযরত মাহ্ বুবে সোবহানী বড়পীর সাইয়্যেদ মুহীউদ্দীন আবদুল কাদের জ্বীলানী (রাঃ) এঁর নাতী মুরীদ ছিলেন ।

বুজুর্গগণের সাক্ষাতঃ   ফারসী মালফুযাত ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ অনুসারে হযরত শায়খ্‌ জালালুদ্দীন (রাঃ) হযরত শায়খ্‌ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী (রাঃ) এঁর মুরীদ থাকাকালে বাগদাদে তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্‌তী (রাঃ)এঁর সাথে সাক্ষাত করেন। তারিখে ফিরিশতার বর্ণনা অনুসারে তিনি নিশাপুরে হযরত শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার(রাঃ) এঁর সাথেও সাক্ষাত করেন।

দেশ ভ্রমণঃ   হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) তাঁর কর্মময় জীবনে বহু দেশ ভ্রমণ করেন তিনি ইয়েমেন মিশর,তুরস্ক,ততকালীন জাজিরাতুল আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের ব্যাপক অঞ্চল সফর করেন। সে সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রগুলোর প্রায় সব জায়গা যেমন মক্কা, মদীনা, বাগদাদ,নিশাপুর, গারজু, সমরকন্দ , বোখারা, মুলতান, বদায়ুন, দিল্লী, আজমীর ইত্যাদি অঞ্চলগুলো সফর করেন। পাক-ভারত উপমহাদেশে শাহ্‌জালাল (রাঃ) একাধিকবার ভ্রমণ করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজের ও তবকাতে নাসিরীর বর্ণনানুসারে হযরত শায়খ জালালুদ্দীন (রাঃ) মুলতানের সুলতান নাসিরুদ্দীন কুবাচা এবং দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশেরশাসনামলে বঙ্গ অঞ্চল সফর করেন। তখন তিনি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী(রাঃ)এঁর মুরীদ ছিলেন। ধর্মপরায়ন সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ হযরত কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ) এঁর মুরীদ ছিলেন। যখন সুলতান জানতে পারলেন যে শায়খ জালালুদ্দীন (রাঃ) দিল্লীতে আগমন করছেন তখন সুলতান সভাসদগণ এবং দিল্লীর আপামর জনগণ হযরতকে সংবর্ধনার জন্য নগরের বাহিরে এগিয়ে গেলেন।শায়খ জালালুদ্দীন (রাঃ) সেখানে পৌঁছলে তাঁর সম্মানে সুলতান ঘোড়ার পৃষ্ঠ থেকে নেমে তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং স্ব-সম্মানে শায়খ জালালুদ্দীন (রাঃ) কে রাজধানীতে নিয়ে আসেন। শায়খ জালাল (রাঃ) এরূপ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পাওয়ায় দিল্লীর শায়খুল ইসলাম নজমুদ্দীন সুগরা ঈর্ষান্বিতহয়ে পড়েন। সুলতান ইলতুতমিশ হযরত ও সংগীদের থাকার জন্য শাহী ব্যবস্থা করতে চাইলে নজমুদ্দীন সুগরা শাহ্‌জালাল (রাঃ) কে পরীক্ষার নাম করে বায়তুল জ্বীন নামে পরিত্যক্ত প্রাসাদে থাকার প্রস্তাব করে। বায়তুল জ্বীন, জ্বীনদের দখলাধীন আবাসস্থল হওয়াতে সেখানে কোন লোকজন থাকতে পারতো না এবং দিনের বেলায়ও সেখানে যেতে সাহস করতো না। প্রভাবশালী সুগরার প্রস্তাবে সুলতান যখন ইতস্ততঃ করছিলেন তখন শায়খ জালাল নিজেই বায়তুল জ্বীনের চাবি চেয়ে নেন।তিনি তাঁর মুরীদ দরবেশ আবু তোরাবের (তাঁর মাজার সিলেট শহরে অবস্থিত) হাতে চাবি দিয়ে বললেন, তালা খুলে ঘরেপ্রবেশ করে উচ্চস্বরে জ্বীনদেরকে বলবে, শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী (রাঃ) এখানে এসেছেন তোমরা অনেকদিন পর্যন্ত এখানে আছ, এখন তিনি অবস্থানকরবেন, তোমরা অন্য কোথাও চলে যাও। একথা বলে আমার এই হামায়েল শরীফ (ক্ষুদ্র কোরআন শরীফ) সে ঘরে ঝুলিয়ে দিও। কথামত কাজ হল। জ্বীনরা প্রাসাদ ছেড়ে গেল এবং শায়খ জালাল (রাঃ) নির্বিঘ্নে সেখানে অবস্থান করলেন।ফওয়ায়েদুস সালেকীন গ্রন্থ অনুসারে হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ) এঁর বর্ণনায় এ সময়ের আরেকটি ঘটনায় নজমুদ্দীন সুগরার ঈর্ষাকাতরতা ও হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) এঁর বুযুর্গী সম্পর্কে জানা যায়। তিনি বলেন- শায়খুল ইসলাম (নজমুদ্দীন সুগরা) জালালুদ্দীন তাবরিজী সম্পর্কে অপবাদ রটনা করলেন। সুলতানের নিকট অভিযোগ পেশ করা হল। শায়খ্‌ জালাল (রাঃ) এঁর বিচার চাইলেন এবং একজন বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব করলেন। নজমুদ্দীন সুগরা এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বললেন, “শায়খ জালাল (রাঃ) যাকে বিচারক ঠিক করবেন তার প্রতি আমারও আস্থা থাকবে। শায়খ জালাল বললেন, আমি শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়াকে বিচারক মানলাম।বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী তখন দিল্লীতে ছিলেন না। নজমুদ্দীন সুগরা অন্য কাউকে বিচারক ঠিক করার জন্য বললেন এজন্য যে শায়খ যাকারিয়া মুলতানী কবে দিল্লী আসেন ঠিক নেই। শায়খ জালাল বললেন, আগামীকালইতিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন। এ কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলেন। পরের দিন দরবার শুরুর পর সবাই বিচারকের অপেক্ষায়। হঠাত শোনা গেল বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী (রাঃ) আসছেন। রাজ দরবারে উপস্থিত হবার পর তিনি প্রথমে হযরত জালালুদ্দীন তাবরিজীর জুতা মোবারক সামনে পেয়ে হাতে নিলেন, চুমু খেলেন ও চোখে লাগালেন। এতে সকলের নিকট শায়খ জালাল (রাঃ) এঁর বুযুর্গী প্রকাশ পেল। অপরাধীরা যার যার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলেন শায়খ জালাল (রাঃ) প্রত্যেককে ক্ষমা করে দিলেন। অন্য আরেক বর্ণনায় জানা যায় এ ঘটনার পর সুলতানইলতুৎমিশ নজমুদ্দীন সুগরাকে শায়খুল ইসলাম পদ হতে অব্যাহতি দেন। এ ঘটনার পর শায়খ জালাল (রাঃ) ততকালীন ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম ভূমি বদায়ুন চলে যান। এ সময় তিনি দিল্লীতে অল্প কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন। বদায়ুন মতান্তরে মুলতান অবস্থানকালে শায়খ জালাল (রাঃ) লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন,“এখানে কোন ওলী-দরবেশ আছেন কি? লোকজন বলল, এখানে কাজী বাচ্চা দিওয়ানা নামক একজন দরবেশ আছেন। তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন এবং একটি আনার/বেদানা দিলেন। এ বাচ্চা দিওয়ানা হলেন হযরত শায়খ ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ (রাঃ)। এটা ছিলতাঁর উপাধি যদিও সে সময়ে তিনি বয়সে বাচ্চা ছিলেন না ।আখবারুল আখিয়ারের বর্ণনায় আরো জানা যায় যে, সেদিন শায়খ ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ(রাঃ)রোযা রেখেছিলেন। এ কারণে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে আনারটি ভাগ করে দেন শুধু নিজের জন্য একটি দানা রেখে দেন। ইফতারের সময় ঐ দানাটি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অভূতপূর্ব এক আধ্যাত্নিক জয্‌বা দেখা গেল। তিনি ভাবলেন আহা! সবটা আনারই যদি খেতে পারতাম তাহলে কতইনা সৌভাগ্য হত। পরবর্তীকালে স্বীয় মুরশীদ কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ) কে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলে তিনি বললেন, আফসোসের কি আছে?প্রকৃত পক্ষে ফলটির একটি দানাই যথার্থ ছিল যা তুমি খেয়েছে।শায়খ ফরিদের বর্ণনায় বদায়ুনের আরেকটি ঘটনা জানা যায়, শায়খ ফরিদ(রাঃ) বলেন, আমরা একটি ঘরে বসেছিলাম, এক দই বিক্রেতা সেই পথ দিয়ে অতিক্রম করছিল। প্রকৃত পক্ষে সে ছিল একজন চোর। হযরত শায়খ তাবরিজীর (রাঃ) প্রতি তার দৃষ্টি পড়তেই তার ভিতরটা একেবারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। সে ইসলাম গ্রহন করলে তার নাম রাখা হয় আলী। এই শায়খ আলী (রাঃ) শায়খ জালাল (রাঃ) এঁর শিক্ষার আঁচলে বাধা পড়ে আত্মজ্ঞানের জগতে এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে বদায়ুনের লোকদের শ্রদ্ধার কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যান। বদায়ুনে খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রাঃ) এঁর শিক্ষা সমাপ্তির পর দস্তারবন্দির(পাগড়ী পরানো) সময় তাঁর ওস্তাদ মহান মনীষী আলাউদ্দিন উসুলী এবং শায়খ আলী বা মওলা আলী (রাঃ)-ই মাথায় পাগড়ী বেধে দেন। সমসাময়িক ইসরারুল আউলীয়া ও আখতার দেহলভীর তাযকিরায়ে আউলিয়ায়ে হিন্দ অনুসারে জানা যায়, শায়খ জালালুদ্দীন কিছুদিন বদায়ুনে অবস্থানের পর আল্লাহ্‌র হুকুমে বঙ্গাভিমুখে রওয়ানা হন। শায়খ আলী (রাঃ) তাঁর সঙ্গে আসতে চাইলে তিনি শায়খ আলী (রাঃ) কে বললেন, আল্লাহ্‌র হুকুমে তোমাকে এই শহরের কুতুব নিযুক্ত করলাম। এ কথা শুনে শায়খ আলী থাকতে রাজি হন। মাওলানা উসুলীও প্রারম্ভিককালে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটি বাড়ির সদর দরজায় এসে পৌঁছান। এখানে শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী শায়খ সোহ্‌রাওয়ার্দীর কাছে অবস্থান করছিলেন। শায়খ তাবরিযীর দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ হয়। আর তাঁর অন্তনির্হিত শক্তি ও যোগ্যতা অনুভব করে গৃহমধ্যে আহবান করে তিনি তাকে তাঁর কোর্তাটি প্রদান করেন ও নিরুদ্দেশ্য জীবনের সদুদ্দেশ্য জানিয়ে দেন । মাওলানা উসুলী বিদ্যার্জনের প্রতি প্রবৃত্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি বিদ্যান রূপে পরিগণিত হন। বদায়ুন থেকে হযরত শায়খ জালাল (রাঃ) মুসলিম বাংলার প্রথম রাজধানী লখনৌতি বা লক্ষণাবতী আগমন করেন। তখন বাংলার গর্ভণর ছিলেন ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ। বাংলায় যাত্রাপথে শায়খ জালাল (রাঃ) কোন এক পুকুর পাড়ে বিশ্রাম করছিলেন। হঠাত উঠে পুকুরে অজু করলেন এবং সঙ্গের লোকদের বললেন, আস, নজমুদ্দীন সুগরার নামাযে জানাজা পড়ি কারণ তিনি এক্ষুনি দিল্লীতে ইন্তেকাল করেছেন। পরবর্তীতে এ ঘটনা সত্যতা প্রমাণিত হয়। লক্ষণাবতীতে শায়খ জালাল (রাঃ) ইসলাম প্রচার করেন। তিনি হিন্দুদের প্রধান মন্দিরের কাছে একটি গাছের নিচে আস্তানা স্থাপন করেন। লোকজন ধীরে ধীরে তাঁর নিকট আসতে থাকে এবং তাঁর ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়। অনেক লোক মুসলমানও হয়। লক্ষণাবতী/পান্ডুয়া অঞ্চলে দেও-দৈত্যের উপদ্রবে মানুষ অশান্তিতে দিন যাপন করত। হযরত শাহজালাল(রাঃ) এর প্রভাবে দেও- দৈত্যগুলো ঐ স্থান ত্যাগ করে।এতে মুগ্ধ হয়ে বহু হিন্দু মুসলমান হয়। মন্দিরের কাছেই ইবাদতের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এভাবে বাংলার মুসলমানদের একটি নব যুগের সূচনা হয়। লখনৌতি থেকে তিনি বাগদাদ প্রত্যাগমন করেন। কারণ প্রতি বছর হজ্বের সময় তিনি স্বীয়মুরশীদ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দীর খেদমতে উপস্থিত থাকতেন।

সিলেটের পথে বাংলায় আগমনঃ   বিভিন্ন জীবনীকারগণের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহ্‌জালাল বাংলাদেশের সিলেটের আগমনের পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুরশীদ ও মামা সৈয়দ আহ্‌মদ কবীর সোহ্‌রাওয়ার্দী এবং সংগীয় পীর বাহাউদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দীর নিকট বর্ণনা করেন। স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে অবিলম্বে হিন্দুস্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে মুরশীদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ,গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাইবে সেখানেই তুমি অবস্থান ঠিক করিবে। তিনি আরও বললেন, এই মৃত্তিকা মুষ্ঠি যে স্থানে পরিত্যাগ করিবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকিবে না। পীরের নির্দেশের পর হযরত শাহ্‌জালাল(রাঃ) বাংলাদেশে আসার আগে জন্মভূমি ইয়েমেন গমন করেন। সেখানে পূর্বপুরুষ ও মাতা-পিতার মাযার যিয়ারত করেন এবং উলুহিয়াতের তত্ত্ব প্রচার করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁর দিকে ধাবিত হয়। এতে ইয়েমেনরাজ ঈর্ষান্বিত হয়ে হযরত শাহজালাল (রাঃ) কে বিষ মিশ্রিত শরবত দ্বারা কামালত পরীক্ষা করতে চাইলেন। হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) বিষ মিশ্রিত শরবত বিস্‌মিল্লাহ বলে পান করলে সে বিষের প্রতিক্রিয়ায় উল্টো ইয়েমেন রাজই মৃত্যুবরণ করে। ইয়েমেনের পরবর্তী রাজা শাহ্‌জাদা আলী পিতার মৃত্যু এবং শায়খ জালাল (রাঃ) এঁর অলৌকিক ঘটনা দেখে তাঁর ভক্তে পরিণত হন এবং শাসকের তখ্‌তে (সিংহাসনে) না বসে শায়খ শাহ্‌জালাল (রাঃ) এঁর সাথী হতে চাইলেন কিন্তু হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) তাকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে ইয়েমেন হতে যাত্রা করেন। ইয়েমেন হতে হযরত শাহ্‌জালাল বাগদাদ আসেন। বাগদাদে হযরত বাহাউদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দীর নিকট হতে পুনরায় বিদায় গ্রহন করেন। সেখানে থেকে বিশ্বের প্রধান প্রধান জনপদে কিছুদিন করে অবস্থান করে সমরকন্দ, আফগানিস্তান হয়ে মুলতান উপস্থিত হন। মুলতান হতে হযরত শাহ্‌জালাল দিল্লীতে এসে উপস্থিত হন। ইয়েমেনের শাহ্‌জাদা আলী সিংহাসন ছেড়ে এ সময়ে তাঁর সাথে মিলিত হন। দিল্লীতে হযরত নিজামুদ্দীন আউলীয়ার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ)দিল্লীতে অবস্থানকালে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রাঃ) এঁর একজন শিষ্য জানালেন যে,আরব দেশ থেকে এক দরবেশ এসেছেন তিনি নারী মুখ দর্শণ করেন না। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে চলেন পথ চলেন এবং সব সময একজন কম বয়সী সুদর্শন বালক কে সঙ্গে রাখেন। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া উতসুক হয়ে একজন শিষ্যকে পাঠালেন দরবেশকে নিয়ে আসারজন্য। হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) অবস্থা বুঝতে পেরে প্রেরিত শিষ্যের হাতে একটি কৌটার মধ্যে তুলা দিয়ে তার উপরে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে কৌটার মুখ বন্ধ করে ফেরত পাঠান। হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া কৌটার মুখ খুলে দেখলেন যে, তুলার উপর একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কিন্তু এতে তুলার একটি আশও জ্বলছে না। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রাঃ) এ ঘটনা থেকে আগত দরবেশের কামালিয়াত ওফজিলত বুঝতে পারলেন এবং নিজেই হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ একজোড়া কবুতর উপহার দেন। সে সময় থেকে আজও এ কবুতর জালালী কবুতর নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। দিল্লী থেকে হযরত শাহ্‌জালাল (রঃ) মুর্শীদ প্রদত্ত মাটি সহকারে বাংলাদেশে আগমণ করেন। খুলনা, রংপুর ,সোনারগাঁ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। এখানে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উলেৱখ করা প্রয়োজন। তা হল, হযরত শাহ্‌জালাল (রঃ) যখন ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান কুমিল্লা সফর করছিলেন তখন কুমিল্লার মাটির সাথে মুর্শীদ প্রদত্ত মাটির মিল পেয়ে তিনি বলেছিলেন কুহু মিলা। কিংবদন্তি অনুসারে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেখান থেকে কুমিল্লা শব্দটির উতপত্তি। কুমিল্লার যে স্থানটিতে একটি টিলার উপরে হযরত শাহ্‌জালাল (রঃ) কিছু দিন অবস্থান করে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্রষ্টার ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন ছিলেন ,সেখানে তাঁর কর্তনকৃত চুল ও নখ প্রোথিত আছে। এখানে নয়নাভিরাম টিলার উপরে ঐ আস্তানাটি রয়েছে। আস্তানাকে কেন্দ্র করে একটি জওয়াব সমাধী,মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। বর্ণিত রয়েছে যে,এই আস্তানাটির নিকটবর্তী শাহ্‌পুর গ্রামে ভারতের ভাগলপুর হতে আগত প্রায় ২৫০ বছর পূর্বের প্রসিদ্ধ আউলিয়া হযরত শাহ্‌ নুরুর্দ্দীন আলক্বাদেরী প্রকাশ্যে হযরত বন্দী শাহ্‌ (রাঃ) প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) মাজার শরীফ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম হযরত শাহ্‌ আমানত (রাঃ) দরগায় পদব্রজে সফর করতেন।

সিলেট বিজয়ঃ    সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে ৭০৩ হিজরীতে শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে গৌড় গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীনের শিশু পুত্র হত্যার প্রতিবিধানার্থে প্রেরিত সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌড় গোবিন্দের ঐন্ত্রজালিক ক্ষমতার কারণে বারবারপরাভুত হয়। অবশেষে হযরত শাহ্‌জালাল(রঃ) ও তাঁর অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াসহযোগে গৌড় গোবিন্দের ঐন্ত্রজালিক ক্ষমতাকে পরাভূত করে সিলেট বিজয় করাহয়।

রিয়াযত ও সাধনাঃ      হযরত শাহ্‌জালাল (রঃ) ছিলেন ইবাদত ও রিয়াযত- সাধনার এক বিস্ময়কর প্রতিক। তিনি সায়েমুদ্দহর ও কায়েমুললাইল ছিলেন অর্থাৎ নিষিদ্ধ দিন ব্যতীত সারা বছর দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে ইবাদতের হক আদায় করতেন।বর্ণিত আছে যে, তিনি কোন রাত্র কিয়ামের জন্য, কোন রাত রুকু, কোন রাত সিজদার জন্য নির্দিষ্ট করে নিতেন । নিম্নে তাঁর ইবাদত ও রিয়াযত-সাধনার কয়েকটি ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন,তিনি (শায়খ জালাল) ৪০ বৎসর হতে বরাবর রোযা রাখতেছিলেন। দশ দিন অন্তর তিনি ইফতার করতেন । তাঁর শরীর ছিল কৃশকায়-পাতলা, আকৃতি ছিল লম্বা গন্ডদ্বয় ছিল ক্ষীণ। ইবনে বতুতা আরো বলেন ,সে দেশের হিন্দু মুসলমান সকলে শায়খের দর্শনের জন্য আসত এবং তাঁকে ভেট(নযরানা) প্রদান করত। তা ফকির ও কাঙাল সকলেই খেত কিন্তু শায়খ কেবল একটি গরুর দুধ পান করতেন। ডঃ জে,ওয়াইজ Notes on Shahjalal the patron saint of Sylhet গ্রন্থে উলেৱখ করেন সুহেল-ই- ইয়ামন গ্রন্থে বর্নিত আছে, for thirty years Shah Jalal is said to have lived in a cave without Crossing the threshold.” ইসরারুল আউলীয়ায় বর্ণিত আছে যে, শায়খ ফরিদউদ্দিন শকরগঞ্জ (রাঃ) বলেন,শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিযী(রাঃ) অধিকাংশ সময় অনাহারে থাকা সত্বেও কাহার নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করিতেন না। একবার তিন দিন পর্যন্ত তাঁহার নিকট কিছুই ছিল না । তিনি ও তাঁহার সাথীগণ তরমুজ দ্বারা ইফতার করিতেন । তথাকার (বদায়ুন) শাসনকর্তা এই সংবাদ পাইলেন এবং এ কথাও জানিতে পারিলেন যে তিনি কাহারও দান-দক্ষিণা গ্রহন করেন না । তাই একজন লোক দ্বারা কিছু আশরফি শায়খের খাদিমের নিকট এ বলে পাঠালেন, যেভাবে ইচ্ছা খরচ কর কিন্তু শায়খ যেন জানিতে না পারেন কোথা হইতে এই খরচ হইতেছে। খাদিম ইহা গোপন রাখা পছন্দ করিলেন না। তিনি শায়খের কাছে সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। শায়খ জিজ্ঞাসা করিলেন – সেই লোক কিভাবে আসিয়াছিল এবং কোথায় কোথায় পা পড়িয়াছিল? খাদিম সব দেখাইয়া দিলেন, শায়খ বলিলেন- সেই ব্যাক্তি যেখানে যেখানে পা ফেলিয়া আসিয়াছে তথাকার মাটি খুঁড়িয়া এবং আশরাফি গুলি বাহিরে ফেলিয়া দাও। হযরত শায়খ জালাল (রাঃ) শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্বে ছিলেন সাত বছর। বর্ণিত আছে শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রাঃ) প্রতি বছর বাগদাদ হইতে পদব্রজে হজ্বে গমন করিতেন। বার্ধক্যের জন্য তিনি ঠান্ডা খাবার হজম করিতে পারিতেন না। গরম খাদ্য পরিবেশনের জন্য শায়খ জালাল (রাঃ) মাথায় একটি জ্বলন্ত চুলা বহন করতেন। বাগদাদ থেকে মক্কা পর্যন্ত গরম খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতেন। এ প্রসঙ্গে ইসরারুল আউলিয়া গ্রন্থে শায়খ ফরিদউদ্দীন শকরগঞ্জ (রঃ) বর্ণনা করেন, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিযি তাহাঁর পীর বাহাউদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর এতটাই সেবা করতেন যে অন্য কোন মুরীদ এতটা করতেন না। একদা তিনি জ্বলন্ত চুলা মাথায় করিয়া যাইতেছিলেন। আমি তাঁহাকেজিজ্ঞাসা করিলাম, কোথায় যাইতেছেন? তিনি উত্তর করিলেন , হজ্বে । তাহার খিদমতের পদ্বতি দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়া গেলাম। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম – কতদিন যাবৎ তিনি এইভাবে পীরের খেদমত করিতেছেন? তাহারা বলিলেন, পঁচিশ বৎসর যাবত আমরা এমনই দেখিতেছি।

সমাজ জীবনে হযরতের প্রভাবঃ হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) প্রেমময় দ্বীনের যে প্রদীপশিখা আল্লাহ্‌র হুকুমে এ বংগ অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন তাঁর আলোয় কত যে অসংখ্য অন্ধকার হৃদয় আলোকিত হয়েছতা আল্লাহ্ তায়ালাই ভাল জানেন। বস্তুত তিনি নিজেই আলোক শিখা। তাঁর আলোয় আলোকিত পুরো বংগ অঞ্চল। এ দেশের জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক ,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে, লোক সাহিত্যে, ধ্র্বপদী সাহিত্যে, শিক্ষা,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সব ক্ষেত্রেই হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর প্রভাব পাওয়া যায়। চিশতিয়া ত্বরিকার বুযুর্গগনের মালফুযাত, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্তিবাংলার শাসকদের বিভিন্ন স্থাপনা ও শিলালিপি, তাঁর নামে স্থানের নামকরন ও মুদ্রা প্রচলনই তা প্রমান করে। বাংলার ইতিহাসে এমন কোন শাসকের দরবার নেই যা হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর দরবারের অনুগ্রহে অনুগৃহীত হতে চায়নি। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কালেক্টর লিন্ডসের আত্মজীবনি থেকে সামান্য উল্লেখ করা হলো – সিলেট পৌছার পর আমলারা আমাকে জানালেন যে, সিলেটের শাসনকর্তার প্রথম কর্তব্য হযরত শাহ্‌জালালের দরগায় যেয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। ভারতবর্ষের দুর-দুরান্ত হতে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা এই দরগায় জিয়ারত করতে আসেন। আমি প্রচলিত প্রথা মোতাবেক জুতা বাহিরে রেখে দরগায় যেয়ে পাঁচটি মোহর নজরানা দিলাম। এরূপে অভিসিক্ত হয়ে আমি প্রজাদের আনুগত্য গ্রহণ করলাম। বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেখা গেছে যারা সিলেট -১ সংসদীয় আসনে (দরগা মহল্লায় ) বিজয়ী হয় তারাই সরকার গঠন করে এবং বর্তমান পর্যন্ত এটা বাস্তব বলে প্রমানিত হয়েছে। এদেশের রাজনৈতিক শাসক যারাই হোকনা কেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগনের হৃদয়ের মনিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে সমাসীন হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) এতদঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট । আর এ কারণেই সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও পূণ্যভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

হযরতের বুযুর্গীঃ হযরত শায়খ শাহ্‌ জালাল ইয়েমেনী (রঃ) এঁর বুযুর্গী ও কামালত সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তায়ালাই উত্তম অবগত। আমরা কয়েকটি ঘটনা ও মনীষীর উক্তি তুলে ধরছি। হযরত শায়খ জালালুদ্দীন যখন তাঁর মামা সৈয়দ আহমদ কবির (রাঃ) এঁর তত্তাবধানে ছিলেন তখন মামার মনোভাব অনুসারে একটি বাঘের যথাযথ উপযুক্ত বিচার সম্পন্ন করার পর সৈয়দ আহমদ কবির (রঃ) বললেন জালাল সুমা বকামাল রছিদি। অর্থাৎ জালাল তুমি আত্ম উন্নতির চরম শিখরে পৌছিয়াছ। ফাওয়ায়েদুল ফওয়াদ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে , একবার শায়খ শিহবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী মক্কা শরীফ হতে আসার পথে ভক্তগন তাঁকে অনেক নজর- নেয়াজ প্রদান করলেন। এক গরিব বৃদ্ধাও হযরতকে একটি দিরহাম প্রদান করলেন। তিনি তাঁর সাথী দরবেশগণ কে প্রাপ্ত দ্রব্য সামগ্রী থেকে নিতে আদেশ দিলেন এবং সকলেই নিজের ইচ্ছামত সামগ্রী উঠিয়ে নিলেন। হযরত শায়খ জালাল কিছুই নিলেন না। শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রাঃ) কিছু নিতে বললে শায়খ জালাল গরিব বৃদ্ধার দেওয়া দিরহামটি উঠিয়ে নিলেন। তা দেখে শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রঃ) বললেন , জালালুদ্দীন! বাহ্যত যদিও তুমি একটি দিরহাম গ্রহণ করলে যাহা সকলের চোখেই নগন্য কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তুমি এমন জিনিস গ্রহণ করলে যা ওই সকল মূল্যবান দ্রব্যাদির আত্মা স্বরূপ তুমি অন্যান্যদে জন্য কিছুই রাখিলেনা চতুর্দশ শতকের বিশখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে হযরত শাহ্‌জালাল (রঃ) কে কেন্দ্র করে লিখেন, অলিয়্য মিনাল আউলিয়া বা আউলিয়াদের ওলি, মিনাল কুবারুল আউলিয়া বা শ্রেষ্ঠ আউলিয়াগনের অন্যতম, মাসিরাল আযিমা বা মহান নির্দেশনাবলির স্থাপয়িতা ও আফরাদুর রিজাল বা মানুষের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে বতুতার বর্ণনায় আরো জানা যায় যে , চীনের বিখ্যাত সূফী সাধক শায়খ বুরহানউদ্দীন সাগরজী (রাঃ) প্রসঙ্গক্রমে বলেন , আমার ভাই শায়খ জালালুদ্দীন এঁর পদবী ইহা অপেৰা অনেক উর্ধ্বে। সংসারের সমস্ত ব্যাপারে তাঁর অধিকার আছে। তিনি আরো বলেন, আমি জানি তিনি প্রত্যেক দিন ফজরের নামায মক্কা শরীফে পড়তেন এবং প্রত্যেক বছর হজ্ব পালন করতেন। তিনি আরাফা এবং ঈদের দিনে অদৃশ্য হয়ে যেতেন কারো কোন খবর হতো না। এছাড়াও ওই সময়ের বিভিন্ন শিলালিপিতে খোদিত আছে , জালালুদ্দীন জালালুলৱাহ আরিফান বুয়দ। অর্থাৎ জালালুদ্দীন আল্লাহর দ্বীপ্তি এবং আরেফগণের গৌরব। জালালুদ্দীন কুতুব বুয়দ অর্থাৎ জালালুদ্দীন কুতুবগনের সুঘ্রাণ। সাকিন আউজ জান্নাত ওয়ালা অর্থাৎ বেহেস্তে তাঁর স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সমাজ জীবনে হযরতের প্রভাবঃ হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) প্রেমময় দ্বীনের যে প্রদীপশিখা আল্লাহ্‌র হুকুমে এ বংগ অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন তাঁর আলোয় কত যে অসংখ্য অন্ধকার হৃদয় আলোকিত হয়েছতা আল্লাহ্ তায়ালাই ভাল জানেন। বস্তুত তিনি নিজেই আলোক শিখা। তাঁর আলোয় আলোকিত পুরো বংগ অঞ্চল। এ দেশের জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক ,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে, লোক সাহিত্যে, ধ্র্বপদী সাহিত্যে, শিক্ষা,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সব ক্ষেত্রেই হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর প্রভাব পাওয়া যায়। চিশতিয়া ত্বরিকার বুযুর্গগনের মালফুযাত, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্তিবাংলার শাসকদের বিভিন্ন স্থাপনা ও শিলালিপি, তাঁর নামে স্থানের নামকরন ও মুদ্রা প্রচলনই তা প্রমান করে। বাংলার ইতিহাসে এমন কোন শাসকের দরবার নেই যা হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর দরবারের অনুগ্রহে অনুগৃহীত হতে চায়নি। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কালেক্টর লিন্ডসের আত্মজীবনি থেকে সামান্য উল্লেখ করা হলো – সিলেট পৌছার পর আমলারা আমাকে জানালেন যে, সিলেটের শাসনকর্তার প্রথম কর্তব্য হযরত শাহ্‌জালালের দরগায় যেয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। ভারতবর্ষের দুর-দুরান্ত হতে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা এই দরগায় জিয়ারত করতে আসেন। আমি প্রচলিত প্রথা মোতাবেক জুতা বাহিরে রেখে দরগায় যেয়ে পাঁচটি মোহর নজরানা দিলাম। এরূপে অভিসিক্ত হয়ে আমি প্রজাদের আনুগত্য গ্রহণ করলাম। বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেখা গেছে যারা সিলেট -১ সংসদীয় আসনে (দরগা মহল্লায় ) বিজয়ী হয় তারাই সরকার গঠন করে এবং বর্তমান পর্যন্ত এটা বাস্তব বলে প্রমানিত হয়েছে। এদেশের রাজনৈতিক শাসক যারাই হোকনা কেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগনের হৃদয়ের মনিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে সমাসীন হযরত শাহ্‌জালাল (রাঃ) এতদঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট । আর এ কারণেই সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও পূণ্যভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

ইন্তেকাল – ১৩৪৬ হিজরি সনের ১৯শে জিলক্বদ হযরত শাহ্জালাল (রাঃ) ১৫০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন , বুরহানউদ্দীন সাগরজী আমাকে বলেন ,“হযরত শাহ্জালাল (রাঃ) ওফাতের একদিন পূর্বে তাঁর মুরিদগণকে ডেকে এ উপদেশ দিলেন যে , ‘তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে, আল্লাহ্কে ভয় করবে। আল্লাহর হুকুমে কাল আমি তোমাদের নিকট হতে বিদায় নিব।’ পরের দিন যোহরের নামাজের শেষ সিজদার অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। আল্লাহপাক তাঁর বন্ধুকে তাঁর কোলে টানিয়া নিলেন। হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর হুজরার পাশে অলৌকিক ভাবে একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া যায়। উক্ত কবরে কাফন ও খুশবো-আতর মওজুদ ছিল। তাঁহার মুরিদগণ হযরতকে কাফন পড়াইয়া জানাজার নামাজ পড়িয়া দাফন করিলেন। আল্লাহ তাঁহার পূত-পবিত্র আত্মার শান্তি বিধান করুন।” উল্লেখ্য হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর হুজরার পাশে মুর্শীদ প্রদত্ত মক্কার মাটি তাঁর নির্দেশে যেখানে প্রোথিত করা হয়েছিল সেখানেই কবরটি খোদিত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রতি বছর হিজরী সনের ১৯ ও ২০শে জিলক্বদ ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। ভেদাভেদ ভুলেগিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লোকজন সুলতানুল বাংলা, প্রাচ্যের সূর্য হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর ওরস শরীফে হাজির হয়ে অপার্থিব প্রশান্তি লাভ করে। হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর ওরস ও দরগাহ্ শরীফের যাবতীয় সকল কাজ কারবার আঞ্জাম একমাত্র মোতওয়ালী মোহদয়ের হুকুমে পরিচালিত হয়। তিনিই একমাত্র যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ । সরেকম মোতওয়ালী জনাব ইউসুফ আমানউল্লাহ বর্তমানে এ পদে বহাল আছেন যাঁর পিতা এ.জেড আবদুল্লাহ্ (রঃ) সিলেট তথা দেশের বিখ্যাত ব্যক্তি ঐতিহাসিকভাবে সুপরিচিত ছিলেন। জনাব ইউসুফ আমান উল্লাহ এঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য জেষ্ঠ্য পুত্র সরেকওম জনাব ফতেউল্লাহ্ আল আমান হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) দরগাহ্ শরীফের যাবতীয় কাজকর্ম ও দায়িত্ব পরিচালনা করছেন তাঁর নিকটের বিশ্বস্ত এবং দায়িত্ব পরায়ন ব্যক্তিদের সহযোতিায়। যেমন – জনাব শামুন মাহমুদ খাঁন (সেকরেটারি,দরগাহ্ শরীফ ), জনাব ওয়ালী মাহমুদ খাঁন ( অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন,সিলেট ) এবং জনাব জুনুন মাহমুদ খাঁন (অবসরপ্রাপ্ত সভাপতি সিলেট চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাসট্রি ) আরও অনেকে।

বলা হয় ১৩৪৬ হিজরীর ১৯ শে জিলক্বদ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের আস্থাভাজন প্রতিনিধি, একজন মহা সাধকের ইন্তেকাল , একজন পূত ব্যক্তিত্বের পারলৈাকিক জীবনে স্থানান্তর সংঘটিত হয়। এ রূপে আমরা মানব মনের ঘৃণ্য দোষ সমূহের মূলোৎপাটন কারী এবং আমাদের বিশ্বাস, দয়া ও সাম্যের অগ্রদূতকে হারালাম। সুলতানুল বাংলা হযরত মাওলানা শাহ্ জালালুদ্দীন মুজার্রদ ইয়েমেনী (রাঃ) আমাদের কাছ থেকে লোকান্তরিত হয়েছেন কিন্তু অক্ষির অগোচর তাঁর জ্যোতির্ময় অস্তিত্ব আমাদের মাঝে বিদ্যমান। আমরা তাঁর কাছ থেকে আল্লাহ ও তদীয় রাসুল (সাঃ) এঁর প্রতি প্রেমাসক্তির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য শুদ্ধতার সঞ্জীবনী লাভ করি। আমাদের জ্যোতি সত্তার স্থায়িত্বের জন্য তাঁর কাছ থেকে আমাদের হৃদয়ে অপার্থিব নির্মলতার আকর্ষণ লাভ করি। আমরা তাঁর চতুর্মুখী ঐশী গুনাবলীর মহিরুহের পুষ্প থেকে সুঘ্রান লাভ করি। আমরা তাঁর কাছ থেকে রাসুল (সাঃ) এঁর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য ও শিষ্টাচারের রীতি-নীতি তথা আদবের উদাত্ত আহবান শুনতে পাই। আমরা অত্যাচার , বৈষম্য ও ভীতি পরিহারের শিক্ষা লাভ করি। আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের প্রার্থনা তিনি আমাদের ‘প্রিয় শাহ্জালালের’ সুনাম ও খ্যাতি প্রতিটি ক্ষেত্রে চতুর্দিকে উৎকর্ষে ছড়িয়ে দিন এবং তাঁর সীমাহীন দয়ার আচ্ছাদনে শাহ্জালাল বাবাকে রাখুন । আমাদের ‘শাহজালাল’ কে আমরা হৃদয়ের গভীরতম তন্ত্রীতে লালন করি এবং আমাদের স্মরণালেখ্য হতে ধর্মীয় ও স্বর্গীয় কর্ম উদ্দীপনা লাভ করি । আল্লাহপাক আমাদেরকেও তাঁর দয়ার আচ্ছাদনে রাখুন এবং হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী (রাঃ) এঁর কর্মগাঁথার পূণ্য হতে আমাদের যেন বঞ্চিত না করেন। আমিন!

সহায়ক গ্রন্থ ১। হযরত শাহ্‌জালাল (র.) দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ইফাবা প্রকাশনা : ১৩৫০/২ ইফাবা গ্রন্থাগার :৯২২.৯৭ ISBN:984-06-0309-4

২। হযরত শাহ্‌জালাল (র.) দলীল ভাষ্য দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রকাশনায়: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ইফাবা গ্রন্থাগার: ৯২২.৯৭, ১৯৯২ ISBN: 984-06-0575-5.

৩। প্রাচ্য-সূর্য আলী মাহমুদ খান প্রকাশক  এনাম মাহমুদ খান, ডাঃ ওয়ালী মাহমুদ খান, শামুন মাহমুদ খান, জুন্নুন মাহমুদ খান খান কটেজ, দরগাহ্‌ মহল্লা ,সিলেট।

৪। আমাদের সূফিয়ায়ে কেরাম সম্পাদনায়ঃ দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রকাশক: পরিচালক, প্রকাশনা বিভাগ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন  বাংলাদেশ। ISBN: 984-06-0374-4.

৫। হযরত শাহ্‌জালাল কুনিয়াভি এ.জেড. শামসুল আলম প্রকাশনায়ঃ খোশরোজ কিতাব মহল লিঃ, ঢাকা।

৬। শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি মুফতি আজহার উদ্দীন সিদ্দিকী পঞ্চম সংস্করণ:২০০২ প্রকাশকঃ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া দরগাহ্‌ মহল্লা, সিলেট।

৭। দরবেশ শাহ্‌জালাল(রাঃ) এস.এম.শরীয়তুল্লা, প্রকাশকঃ আলহাজ্ব মুহাম্মদ বশির মিয়া ভাটিপাড়া,বিশ্বনাথ,সিলেট।

৮। ইসলামী বিশ্বকোষ ইফাবা,২য় সংস্করন, ২য় খন্ড।